Saturday, December 31, 2016

ভুলতে পারিনি



ভুলতে পারিনি
ভালবাসার গল্প বলা খুবই সহজ। কষ্ট শুধু তাদের যারা অনুধাবন করেন।আজকের দিনে প্রেমিক প্রেমিকা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ছেলে মেয়েরা।তাদের কারো কারো মতামত অনুযায়ী বিয়ের ব্যবস্থাও করা হয়। কিন্তু এমন অনেকে আছেন যাদের বুকের ভিতরে ভালোবাসার স্মৃতি , জমে জমে কঠিন বরফে পরিনতে হযে গেছে।কখনো কখনো হৃদযের জিহ্বা থেকে সেই বরফ গলে পড়ে।তেমনি একটি সংকলিত ভালবাসার স্মৃতি তুলে ধরছ্
কোর্ট ম্যারেজ করার ভয়ে ভালোবাসার স্বীকৃতি দিতে পারিনি। যে ভালোবাসার মানুষটাকে একটি দিনের জন্যেও ভুলতে পারিনি।
আজ থেকে অনেক দুরে । প্রায় দুই যুগ ধরে সাগর পাড়ে প্রাবাসী হয়ে আছে। জানি না তার কখনো আমাকে মনে পড়ে কি না। আমাকে মনে না রাখারই কথা। কারন পারিবারিক চাপে আমি অন্যত্র বিয়েতে মত দিয়েছিলাম। আমরা সহপাঠী ছিলাম।এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে অবসর কাটাচ্ছিলাম দুজনা। সেই সময় পরিচয়। প্রথমে বন্ধু তারপর ভালোলাগা যে কবে ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়েছে তা বুঝতেই পারিনি। দিনটি ছিলো ৬ এপ্রিল দুজন দুজনার কাছে ধরা পড়লাম। সেই থেকে ভালোবাসা আরো গভীর হলো। তার সঙ্গে গল্প করে তার চিঠি পেলে আনন্দে আত্মহারা হতাম। দৈহিক প্রেম নয়। কিন্তু মনের দিক থেকে আমরা একে আপরের জন্য পাগল ছিলাম যতোক্ষন এক সঙ্গে থাকতাম ততোক্ষনই ভালো লাগতো্ তরুন বয়সের সেই সব ঝলমলে স্মৃতি এতো বছরেও একটা দিনের জন্যেও ভুলিনি। সেই ভালোলাগার দিনগুলো খুব মধুর ছিল।
কিন্তু আমার ভাগ্যে প্রসন্ন ছিলো না। তাকে লেখা আমার একটা চিঠি তার গুরুজনের হাতে পড়ে গেলো্ তারা আমার বাবা মার কাছে নালিশ করলো এতে আমার বাবা-মা খুব অপমানিত বোধ করলেন্ সেই থেকে আমার ওপর নেমে আসে নানা রকম বিধি-নিষেধ।তখনকার দিনে আমরা মেয়েরা একা একা খুব বেশি বাইরে বের হতাম না্ তাই কলেজ পালিয়ে দেখা করতাম। চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। এভাবে সবার চোখ ফাকি দিযে যোগাযোগ করতাম্ চার বছর খুব কষ্ট করে কাটালাম্ কিন্তু আমার বাড়িতে অশান্তি নেমে আসে ভীষনভাব্
আমরা তিন বোন ছিলাম্ দেখতে মোটামুটি ভালোই ছিলাম্ আমি বড় তাই নানান জায়গা থেকে বিযের প্রস্তার আসতে লাগলো। নানান অজুহাতে সব নাকচ করছিলাম্
আমার আব্বা আম্মা সবই বুঝতেন।
মা ছিলেন খুব রগচটা প্রকৃতির মহিলা। আমাকে মারধর গালিগালাজ করতেন প্রতিদিন। চোরের মতো থাকতাম সব সময় চোখের পানি ফেলতাম, আল্লাহকে ডাকতাম।আব্বু ঠান্ডা মাথার লোক ছিলেন। আমাকে অনেক বোঝাতেন, আমি যেন পরিবারের বদনাম করে কোট ম্যারেজ না করি। আব্বার মাথায় হাত রেখে শপথ করেছিলাম কোর্ট ম্যারেজ করবো না। কিন্তু আমার স্বস্থ্য ভেঙ্গে গেলো। ভীষনভাব্ চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে গেলো কাদতে কাদতে। দুর থেকে মানুষ দেখলে চিততে পারতাম না। আব্বা আমাকে একটা সুযোগ দিলেন। ওই ছেলেকে বলো, তাদের বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আনতে।
খুব কষ্ট করে তার সাথে যোগাযোগ করে বললাম। সে বললো বাসা বলতে পারবো না চলো নিজেরা বিয়ে করি।আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বাসায় এসে প্রচন্ড জ্বরে বিছানায় পড়লাম্ আমার দুর্বণ মনে দুর্বল শরীরে । কোট ম্যারেজের কথা শুনলেই ভয় পেতাম। মনে হতো কোর্ট ম্যারেজ করলে আমার আব্বা মারা যাবে।আমার জণ্যে ছোট বোনেরাও বিপদে পড়বে আব্বাকে দেয়া কথা রাখতে গিয়ে আমার জীবনের সব আনন্দ হারালাম।
সেই সময় আত্মহত্যা করিনি ঠিকই কিন্তু আম্মাকে হত্যা করলাম।
গুরু জনদের চাপের মুখে বিয়েতে মত দিলাম । বিয়েরে কয়েকদিন আগে তার চিঠিগুলো পড়লাম । পাগল হয়ে বাসা থেকে বের হলাম। কিন্তু যার মাধ্যমে যোগাযোগ করতাম সেই ছেলেটা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলো । তখন ১৯৭১। সেই দিন তার সাথে যোগাযোগ করতে পারলে সব কিছু অন্য রকম হতো্ বাসায় ফিরে তার কথাও চিন্তয় এলো্ সে তখন স্টুডেন্ট ।তখন বিয়ে করলেও সে আমাকে কোথায় আশ্রয় দেবে তার ভবিষ্যত নষট করবো। এসব ভাবলাম। কিন্তু এখন বুঝি এসব ঘটনা এতো চিন্তা ভাবনা করে হয়না।তখন বাড়ির মুরব্বিরা বলেছিলেম আমার ভগ্যে তার সাথে বিয়ে নাই।
আমার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলো। সে জানতেও পারলোনা ।তাকে বলেছেলাম যুদ্ধ শুরু হলেবিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে।
১৯৭১সালের মার্চে তার সাথে আমার শেষ দেখা হলো।বিয়ের পরও প্রতিটি দিন তাকে মনে করেছি। তার কুশল কামনা করেছি। কিন্তু যোগাযোগ কারা চেষ্টা কখনো করিনি। তবে তার খবর কিছু কিছু জানতাম। সে বিয়ে করেছে এবং স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে সুখেই আছে।

বুটা ও দীপা



 

বুটা ও দীপা

ভালোবাসা নিয়ে বর্তমানে আমাদের দেশে মাতামাতির শেষ নাই। হাজার হাজার অনুষ্ঠান, পার্টি গান-বাজনা ইত্যাদি। কিন্তু আমরা কখনো প্রেম ভালোবাসা বিষয়ক কবিতা, গল্প কিংবা উপন্যাসকে সালের কিংবা শতাব্দির সেরা নির্বাচিত করি না।
কিছু কিছু সত্যি ঘটনা আমাদের প্রচন্ড নাড়া দেয়। আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তেমনি একটি আমাদের এই উপমহাদেশের মর্মস্পর্শী প্রেমের সত্য ঘটনা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। নিচের সত্য ঘটনাটি ডমিনিক লাপিয়ের ও ল্যারি কলিন্স এর বিখ্যাত গ্রন্থ ফৃডম অ্যাট মিডনাইট থেকে নেয়া। আমার মতে এটিই এই উপমহাদেশের বর্তমান যুগের সেরা প্রেম কাহিনী।
পাকিস্থান থেকে ভারত বা ভারত থেকে পাকিস্থান পুর্নবাসন সময়কার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ডামাডোলে থেকে সৃষ্ট এই প্রেমের ঘটনার সময় সেপ্টেম্বর-আক্টোবর ১৯৭৪ থেকে ১৯৫৭। শেষ ভইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন এর ফৌজি বিভাগে চাকরি করতো বুটা সিং। বয়স পঞ্চান্ন । অবসর নিয়েছেন। বিয়েও করেননি। জমিজমা নিয়েই অবসর সময় কাটতো তার।
একদিন তিনি ক্ষেতে কাজ করছেন হঠাৎ চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো এক মেয়ে। পেছন পেছন মারমুখো এক শিখ।বুটা সিং দাড়ালেন মাঝখানে। চোখের পলকে বুঝলো ঘটনা। অনেক মেয়েই তখন ধির্ষিতা হতো সব দুবৃত্তর হাতে। তারপর বিক্রিও করা হতো বিভিন্ন জায়গায়। সেই শিখ দুবৃত্তের কাছ থেকে পনেরোশ টাকার বিনিময়ে এই মেয়েটিকে মুক্ত করলেন। তারপর বদলে গেলো তার জীবন।মুক্তি পাওয়া মেয়েটা আশ্রয় পেল তার ঘরে। পঞ্চান্ন বছর বয়সে বুটা সিং অনুভব করলো প্রেমের মহত্ব। মুক্তির স্বাদে নিজেকে বিলিয়ে দিল যে মেয়েটি বুটা সিংয়ের কাছে তার নাম দিপা। বয়স মাত্র সতেরো।এরপর একদির শিখ মতে বিয়ে হলো তাদের। বিয়ের এগার মাস পর দীপার কোল জুড়ে এলো কন্যা সন্তান। আনন্দের বন্যায় যেন ভাসতে লাগলো বুটা সিং। খুলে বসলেন ধর্ম গ্রন্থ। পাতা উল্টে যে শব্দ প্রথম দেখলেন , সেটাই রাখলো তার মেয়ের নাম “তনবীর”। অথচ ধারনাও করলেন না ভবিষ্যত কতো মর্মান্তিক হতে যাচ্ছে।জীবনে নেমে আসছে কতো ভংঙ্কর ঝড়।
তিন কুলে বুটার বেচে ছিল দুই ভাইপো। তারা অনেক দিন পর ফিরে তো অবাক। বুটার সুখ সহ্য হলো না তাদের। বুটা বিয়ে করেছে সুতরাং জমি-জমা তাদের কপাল থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।সে সময় দীপার মতো যে সব মেয়েরা ধর্ষিতা হতো অথবা অভিবাসনের সময় হারিয়ে যেতো বা ঠিকানা বিহীন তাদের পুর্নবাসনের জন্যে ভারত পাকিস্থান সরকার এক আইন জারি করে। খোলা হয় আশ্রয় ক্যাম্প। আশ্রয় ক্যাম্প থেকে দেশত্যাগ কিংবা অভিভাবকের কাছে যাওয়ার রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা রাখা হয়।
দুই ভাইপো জানিয়ে দিল সব। আশ্রয় ক্যাম্প থেকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল দীপাকে। বুটা যেন জীবনের শেষ্ঠ সম্পদ হারালেন। প্রথমে আশ্রয় ক্যাম্পে তার স্ত্রীকে ফেরত চাইলেন। বললেন সে তো আশ্রয়হীনা কোন মেয়ে নয়। লাভ হলো না। আশ্রয় ক্যাম্পের কর্মকর্ত্াদের মন গলাতে তিনি ব্যর্থ হলেন।
ছুটলেন দিল্লির পথে। কিন্তু যা করে গেলেন তা শিখ বংশের জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ।চুল দাড়ি কেটে দিল্লির বড় মসজিদে গিয়ে কলেমা পড়ে মুসলমান হলেন। জামিল নাম নিয়ে তিনি ছুটলেন পাকিস্থান দূতাবাস্ তার বিবিকে ফেরত চাইলেন। কিন্তু কোন লাভ হলো না। এক সকারে দীপার মা-বাবা এসে ক্যাম্প থেকে নিয়ে গেলো। বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো কাদলেন বুটা। যদিও দীপা প্রতিজ্ঞা করে গেলো, পাকিস্থানে গিয়েও সে প্রতীক্ষা করে থাকবে।অার কখনো বিয়ে করবে না।বুটাই তার জীবন-মরন।
বুটার জন্যে অপেক্ষা করছে আরো করুন দৃশ্য।
মুসলিম হিসেবে বুটা এবার পাকিস্থানে পূর্নবাসন হতে চাইলো।কিন্তু পারলেন না।আরো কিছুদিন পরে ঘুরেতে যাবেন বলে পাকিস্থান দূতাবাসে গিয়ে ভিসার আবেদন করলেন। সেটাও মিললো না। তখন নিরুপায় হয়ে জীবন বাজি রেখে সেই বুড়ো বুটা সিং তার মেয়েকে নিয়ে সীমান্ত পথ পাড়ী দিয়ে চলে এলেন পাকিস্থান।দীপার গ্রামে এসেই প্রথম মানসিক ধাক্কা খেলেন বুটা। কয়েক মাস আগেই দীপার বিয়ে হয়েছে তার এক জ্ঞাতী ভাইয়ের সাথে। তিনি তখন পাগলেন মতো কাদছেন দীপার বাড়ির সামনে। তখন লোকজন তাকে মারধর করছে। সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গার আবহাওয়া পারলে তখনই মেরে বুটাকে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তারা অর্ধমৃত বুটাকে পুলিশে দিল।
বিচার শুরু হলো বুটার। বুটা ফেরত পাইলেন তার স্থীকে। বিচারকের কাছে তিনি করুন মিনতি জানালেন অন্তত একবার যেন তার স্ত্রীর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করা হয়।এই প্রথম বুটার আবেদন অগ্রহ্য হলো না। খবর পেয়ে সারা গ্রাম আদালত প্রঙ্গনে হাজির হলো। উত্তেজিত গ্রামবাসীর মনোভাব তাদের মেয়েকে কেউ ভিনদেশে নিয়ে যেতে পারবে না। আদালত প্রাঙ্গনে দীপা বুটাকে সনাক্ত করলো বুটাকে এই বলে যে, সে আমার প্রথম স্বামী। মেয়েকেও চিনলো। তারপর কাদতে কাদতে বললো বুটার সাথে সে ভারতে ফিরে যেতে চায় না। যে মেয়েটার জীবনে সে ফিরিয়ে দিয়েছিল আনন্দ, আজ সেই দীপাই ফিরিয়ে দিল তাকে। শোকে পাথর বুটা সিং করুন মিনতি জানালো। দীপা যেন মেয়েটাকে তার কাছে রাখে। তিনি নিজে আর কখনো মা-মেয়ের মুখোমুখি হবেন না। উত্তেজিত জনতার চোখে চোখ রাখলো দীপা। হিংস্রতা তাকে যতোটা ভীত করলো সেই ভয় নিয়ে সে কাদতে কাদতে বললো, মেয়েটাকেও সে নিজের কাছে রাখতে চায় না।
হয়তো মেয়ের ভবিষ্যত চিন্তা করে এমন কথা বলে ফেলতে পারে দীপা।দীপার কথা শুনে কাঠগড়ায় গড়িয়ে কাদলেন বুটা সিং।তারপর মেয়েটাকে কোলে করে বেরিয়ে এলেন আদালত থেকে।পকেটের সব টাকা খরচ করে মেয়ের জন্যে নতুন জামা-কাপড় কিনলেন।ভালো করে খাওয়া দাওয়া করলেন।তারপর এসে পৌছলেন লাহোর’র শাহদারা রেলষ্টেশনে। ট্রেন যখন আসছে তখন মেয়েটি আশ্চর্য শান্তিতে ঘুমোচ্ছে বুটার কোলে। বুটা ট্রেনে সামনে এসে দাড়ালেন।ট্রেনের ধাক্কায় প্রথমেই হাত থেকে দুরে ছিটকে পড়লো মেয়েটি এবং বেচে গেলো।খৃন্ড বিখন্ড হলো বুটা সিং এর দেহ।যাত্রীদের মধ্যে হইচই পড়ে গেলো। মেয়েটি কাদছে অঝোরে। মৃত বুটার পকেটে পাওয়া গেল একটা ছোট্ট চিঠি।

প্রিয় দীপা,
আমি জানি লোকের সামনে তুমি যা বলেছো সেটা তোমার মনের কথা ছিল না। তুমি সকলের কথা শুনলেও আমার মনে হয, তুমি অবশ্যেই আমাকে ভালোবাসো। আর এ কারনেই আমার শেষ দাবী। অন্তত তোমার গ্রামে আমার কবরটা দিও।আর মাঝে মাঝে এসে আমার কবরে ফুল দিও।

বুটা আত্মহত্যা করেছিল ২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৫ সালে।