পাগলী
আবদুল
কুদ্দুস । বয়স ত্রিশের মতো হবে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, বাড়ি হবিগঞ্জ। একটা বিদেশি
সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ঘুনিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের নিমাণ কাজে সোনাগাছির এ গ্রামে
এসেছে। মার্জিত ব্যবহার আর বন্ধবাৎসল্যের কারনে অল্পদিনেই আমাদের মতো অনেকেই তার
খুব ভালো বন্ধতে পরিনত হয়েছে।কারো সাথে যে খারাপ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়নি এমনো নয়।
সাবকন্ট্রাকপরের স্থানীয় কিছু শ্রমিক তার ওপর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারনে বড়িই নাখোশ।
এই এলাকার
বেশ কিছুদিন থেকে একটা অল্প সয়সী পাগলীর আনাগোনা অনেকেই লক্ষ্য করেছেন।অতি উৎসাহী
কিছু লোক এটাও লক্ষ্য করেছেন যে, পাগলিটার পরনে প্রায়ই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জামা
প্যান্ট শোভা পাচ্ছে।প্রতিদিনের মতো একদিন সকালবেলা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাইট
সংলগ্ন চায়ের দোকানে গেলাম। চায়ের দোকানের সবাই এতক্ষন কি একটা রসালো বিষয় নিয়ে
আলোচনা করছিল্ আমাকে দেখে সবাই চুপ। চা খেয়ে দোকান থেকে পাানের গোদা কাশেমকে নিয়ে
বেরিয়ে পড়লাম। ব্যাপার কি জানতে চাইলাম।
কাশেম বললো
গতরাতে এক নির্জন স্থান থেকে তারা ইঞ্জিনিয়ার আর পাগলিকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে
পেয়েছে।পাগলীকে দুই চার ঘা আর ইঞ্জিনিয়ারকে বেশ ধোলাই দেয়া হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার বেটা
রাত থাকতেই কাপড় চোপড় নিয়ে ভেগেছে।
বিশ্বাস বা
অবিশ্বাস করার মতো প্রমান না পেয়ে বেশ অস্বস্তিতে ভুগছিলাম।ঘটনার ১২দিন পর
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একটি চিঠি পেলাম।
চিঠির
ভাষা-
অঅমি তখন
এসএসসি পরীক্ষাথী। ছোট বোন রেখা ক্লাস নাইনে, তার পরের বোনটি এইটে। ব্যবসায়ী বাবা
আর গৃহিনী মাকে নিয়ে খুবই সুখের সংসার আমাদের। কৃখের পরেই নাকি দুখ আসে। বুঝলাম যখন
ছোট বোন রেখা কামার পাড়ায় এক হিন্দু ছেলের সাথে পালালো।সারা পাড়ায় ছিঃছিঃ পড়ে
গেলো। আমি আর ছোট বোন শিখা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। সাতাশ দিনের মাথায়
হেডমাষ্টার এসে স্কুলে নিয়ে গেলেন আমাদের। রেখা পালিয়েছে প্রায় এক বছরের উপর হলো।
ঘরপোড়া গরু সিদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।শিখার বিয়ের বয়স যদিও হয়নি তারপরেও বাবা
উঠেপড়ে লাগলেন তাকে বিয়ে দেয়ার জন্যে।রেখার কেলেংকারী যারা জানে অথাৎ আমাদের
আশেপাশের দুই চার গ্রামের কোথাও থেকে বিয়ের কোনো প্রস্তাব আসেনি। দুর দুরান্তের
কোনো গ্রাম থেকে যদিও বিয়ের প্রস্তাব আসে একই কারনে তাও ভেঙ্গে যায়। বাবার টেনশন
মায়ের সাথে দুরব্যবহার, আমাদের সঙ্গে রাগারাগীর সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো।পাকা রাস্তার
পাশেই আমাদের বাড়ি। একদিন ভোরে মা উঠানে একটা পাগলিকে দেখে রেখা বলে চিৎকার দিয়ে
পড়ে যান। আমি বাবা আর শিখা চিৎকার শুনে বেরিয়ে আসি । মাকে নিয়ে বাবা আর শিখা
টানাটানি করছে আর আমি গিয়ে পাগলিটাকে কয়েক ঘা লাগিয়ে দেই। মার হুশ ছিল। চিৎকার করে
দৌড়ে এসে আমাকে বাধা দেন। বললেন ভালো করে দেখ কাকে মারছিস, ও আমাদের রেখা।অঅমরা এ
কাকে দেখছি। পরনে একটা নতুন গামছা, গায়ে ময়লা একটা কোট। করুন পর্ব শেষে রেখাকে
গোসল করাতে নিয়ে গেলে তার কোটের পকেটে একটা চিঠি পাওয়া যায়। পত্র লেখক লিখেছে।
আমার সাধ্যের সব রকমের চিকৎসা তাকে করিয়েছি। সে এখন চিকিৎসার অনেক উর্দ্ধে। প্রায়
এক মাস নিরুদ্দেশ থাকার পর আপনাদের শহরেই তাকে খুজে পেয়েছি।কোথায় নেবো ভেবে পেলাম
না। তাই আপনাদের এখানেই রেখে গেলাম।আমাকে ক্ষমা করবেন। বদ্ধ উম্মাদ রেখাকে আট দিন
একটা ঘরে বন্ধ করে রাখা হলো। আমাদের ঘরের লোক ছাড়া আশে পাশের কেউ যেন রেখার
অস্তিত্ব টের না পায় সেজন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।এই আটদিনে তার পরনে কোন
কাপড় পরানো যায়নি।কোনোকিছু মুখেও দেয়নি।মা সারাক্ষন কান্নাকাটি করেন। আমি শিখা
পারতপক্ষে বিবস্ত্র রেখার সামনে যাই না। বাবার হবভাবে বোঝা যায়, রেখাকে খুন করে
মাটি চাপা দিতে পারলেই যেন তিনি বাচেন। আমার এক মামা মাইক্রোবাস চালাতেন। নবম দিন
ফজরের নামাজের আগে গাড়ি নিয়ে মামা এলেন। কোনো রকমে একটা প্যান্ট পরিয়ে টেনেহেচড়ে
রেখাকে গাড়িতে তোলা হলো। মায়ের সেকি বুক ফাটানো আর্তনাদ। আমি আর শিখাও কাদছি।
বাবাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস না পেয়ে মামাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, রেখাকে
চিকিৎসার জন্য পাবনা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরের দিন সন্ধ্যায় বাবা ফিরলেণ। এই প্রথম
বাবাকে কাদতে দেখলাম। সারা রাত তিনি কাদলেন। ফজরের পরে আমাকে ডেকে বললেন, তোর
মামাকে গাড়ি নিয়ে আসতে খবর দে। অঅমি লক্ষ্য কলাম এক রাতে যেন বাবার বয়স অনেক বেড়ে
গেছে।চোখ কোটরে যেন এক অর্থব বৃদ্ধ।
গাড়ি নিয়ে
মামা আর বাবা আবার বের হলেন। তিন দিন পর দুপুরবেলা মাইক্রোবাস এস থামলো আমাদের
বাসার সামনে। মামা দরপা খুলে দেখন পছেনের সিটে হেলান দিয়ে বাবা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
বাবার এ ঘুম আর কখনো ভাঙেনি। আমাদের শোকের সীমা রইলো না।আমাদের শোকের সাগরে
ভাসিয়ে দিয়ে বাবা চিরতরে বিদায় নিলেন।পরে মামার কাছে শুনেছি তারা দুজনে মিলে
রেখাকে কয়েক’শ কিমি দুরে এক স্থানে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন। পরের দিন বের হয়ে মামা আর
বাবা তিন দিন পযন্ত রেখাকে খুজেছেন, আর কোথাও খুজে পাননি।এই তিনদিনে বাবা কিছুই
খায়নি। শুধু রেখা রেখা বলে কেদেছেন।সেদিনের পর থেকে পথেঘাটে কোন পাগলিকে দেখলে
আমার হারিয়ে যাওয়া পাগলীর কথা মনে পড়তো।এদের মাঝে আমার রেখাকে খুজে পেতাম যদিও
জানি এরা কেউ সত্যিকারে রেখা নয়।তারপরও এরা তো কারো না কারো আদরের বোন ছিলো ।
সেদিন
আপনাদের এলাকায় আমার ওই পাগলী বোটিকে বিবস্ত্র দেখে আমার একটি প্যান্ট পরানোর চেষ্টা
করছিলাম। এরপরের ঘটনা তো নিশ্চয় আপনি জানেন।