Tuesday, February 12, 2019

জান্নাতের ভালোবাসার জয়

জান্নাতের ভালোবাসার জয়
দিনটি ছিলো ৪ আগষ্ট ২০১৭ শুক্রবার। জুম্মার নামাজ শেষ করে এসে জান্নাতকে দেখি। আমাদের পরিবারের সবাই জান্নাতকে পছন্দ করলো। সবাই আমার মুখের পানে চেয়ে। আমার " হ্যা" বলার অপেক্ষায়। আমার হ্যা বলতে দেরি হলেও,  আংটি পরানোর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না। আমার আম্মা তার নিজের হাতের আংটি খুলে জান্নাতকে পরিয়ে দিলো।
ওর পুরো নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। আমি ওকে সংক্ষেপে জান্নাত বলে ডাকি। ভালবেসে আমি ওকে এই নাম দিয়েছি। জান্নাত আমার সুখের উদ্যান। এই জান্নাতকে নিয়ে আমার আজন্ম ঘর-গৃহস্থলী, স্বপ্ন সুখ।  মরু জীবনে ভরা শীতল জলের সরোবর।
জান্নাতের নিজেরও নামটি ভারী পছন্দ হয়েছে। কেনোইবা হবেনা, আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার বহুল সমাহার এর সারমর্ম হিসেবে জান্নাত নামটি বেছে দিয়েছি।
আর কি বা দেবার আছে আমার।  নাও, আমি নিজেকেই দিয়ে দিলাম। সঙ্গে দিলাম অফুরন্ত ভালোবাসা যা ছিল সঞ্চয় আমার।
জান্নাত তোমাকে আরো দিলাম ভূবন ডাঙ্গার মেঘলা আকাশ, আমার বোতাম বিহীন ছেড়া শার্ট।
ওকে দেখা মাত্রই আমার হৃদয় ঘন্টা টুং টাং  আওয়াজে বাজতে শুরু করল। হয়তো জান্নাতের হৃদয়ের ঘন্টাটাও বেজেছিলো। না হলে আমারটা বাজতো না। যেমনটি গুণীজনেরা বলে গেছেন যে, একহাতে তালী বাজেনা।
জান্নাতের সাথে কথা বলে জানতে পারি আমাদের দু'জনের পছন্দ অপছন্দের যথেষ্ট মিল রয়েছে। প্রথম দেখাতেই আমরা দুজন ভেবে নিয়েছি, আমাদের দুজনের দেখা হওয়াটা আল্লাহর অশেষ রহমতের একটা দৃপ্তমান দৃষ্টান্ত।
নদী যেমন পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল,  সমতল পেরিয়ে সাগরে মিশে তেমনি আমিও । যে নারীর মধু প্রেমে আমার রক্ত দোলে  সে জান্নাত। জান্নাত আমার সুখের নাম, আমার সর্বনাসের ও। এই জান্নাতের খোজে এতটা বছর জীবন হাতের মুঠোয় করে ছুটে বেরিয়েছি।  দুরন্ত ষাড়ের চোখে বেধেছি লাল কাপড়। আর কত রং বেরঙের নারীর মাঝে খুজেছি তাকে কিন্তু
পাইনি।
আজ তাকে পেয়েছি, আর কি বসে থাকা যায়, হৃদয়ের মনিকোটায় ছোট ছোট নুড়ি সংগ্রহের কাজ শুরু হলো। যতদ্রুত সম্ভব স্বর্নখচিত ভালোবাসার ঘর তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। আমার জান্নাত অপেক্ষায় আছে।
আমার জান্নাত বলছি কারন পারিবারিক ভাবে আমি জান্নাতকে আংটি পরিয়ে আমার জান্নাত বলে জগৎ সংসারে জানান দিয়ে এলাম।
হাজারো জল্পনা কল্পনায় সময় দ্রুত কাটছিলো। আধারের আগমনে পালিয়ে গেলো দিনের আলো। তখন রাত ৯টা। আমি খুলনা থেকে ঢাকার পথে যাত্রা করলাম। রাত শেষ হবার আগেই আমাকে সাড়ে তিনশো কিমি পথ পাড়ি দিয়ে সকালে এসে অফিস করতে হবে। আমার মাথার খুলিতে অফিস অার হৃদয়ের ঝুলিতে জান্নাত। নাইটকোচ রাতের নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে, আধারেরর বুক চীরে আপন মনে হর্ণ বাজিয়ে দূর্বার ছুটছে গন্তব্যের পানে। আর আমি হারিয়েছি আমার জান্নাতের ভাবনায়।  তন্দ্রকাটে মোবাইলের ক্রিং ক্রিং শব্দে।  মোবাইলটা কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপার থেকে সুমধুর কিশোরী কন্ঠে ভেসে অাসে "আসসালামু আলাইকুম"।
বাতাসের শো শো শব্দের হিংসাত্বক মনোভাবে আমাদের কথোপথন বেশিদুর এগোতে পারেনা। শুধু কুশল বিনিময়ে শেষ হয়।  এরই ফাকে জান্নাত বলে গেলো "অপেক্ষায় রইলাম, পৌছে ফোন দিবেন।"
আমার বিরক্তিকর বাস ভ্রমন। আনন্দ ভ্রমনে রুপান্তরিত হলো। হৃদয় মাজারে সুখের হাওয়া বইতে শুরু করে। শুকনো পাতা ফিরে পেলো সজীবতা। আর বাগানে ফুটলো এক নতুন কুড়ি যা আগে কখনো ফোটেনি।
কখনো ব্রক্ষপূত্রের উত্তাল সমুদ্রে ডিঙি ভাসিয়েছি কখনো আবার হাতে হাত রেখে হেটেছি সাদা কাশফুল ছুয়ে। এমনই নিমিঝিমি ভাবনায় রাত পার হয়ে গেলো।  আনুমানিক সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকায় পৌছাই। সারারাতের অপেক্ষমান জান্নাতকে ফোন করে জানালাম,  আমি পৌছেছি।  অমলীন হাসি মিশ্রিত আত্মতৃপ্ত কন্ঠে ওপার থেকে ভেসে এলো " অালহামদুলিল্লাহ"।
এরপর অফিস,  অফিস অবসরে ফোনকরা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আমাদের কথপোথনের সময়সীমা।
অদৃশ্য এক আকর্ষন অনুভূত হতে থাকে হৃদয় থেকে হৃদয়ে। একটু সময় গড়িয়ে গেলে মনে হয় নাজানি কতক্ষন কথা বলিনি। এভাবে দিন বাড়ার সাথে সাথে কথা বলার সময় লাফিয়ে লাফিয়ে চলে মিনিট থেকে ঘন্টায়।  দুজন দুজনার তরে ব্যকুল।  শুনতে ইচ্ছা করে অনেক না বলা কথা, বলতে ইচ্ছা করে হাজার ভালোবাসার রুপ।
হৃদয় দিয়ে দুজন দুজনকে বুঝতে চেষ্টা করি। হয়ে উঠি দুজন দুজনার হাসি-কান্না, সুখ দুঃখের সমভাগী। 
প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে দুজনই  নেমে আসি আপনি থেকে তুমিতে।
এমনকি নিজেদের প্রেমিক প্রেমিকা  থেকে বদলে স্বামী-স্ত্রী রুপে মনের দেয়ালে আপন খেয়ালে ভালোবাসার মানুষের ছবি আকতে থাকি।
এমন ভাবনার নিশ্চই কারনও ছিলো। কারনটি হলো ১৫ই আগষ্ট আমাদের বিয়ের দিন ধার্য করা হলো।  তাই এমন ভাবাটা নিশ্চই অপরাধের কিছু নয়। আর কেউ আমাদের বাধাও দেয়নি,  বরং সকলেই সমর্থনের সাথে সাথে সহযোগীতাও করেছে। তাতে করে আমরা মন খুলে কথা বলতে পেরেছি।
বিপত্তি ঘটলো অন্যখানে। যেখানে যা ঘটার ছিলো না তাই ঘটলো। আরমাত্র তিনদিন পর আমি আমার জান্নাতকে নিয়ে ভালোবাসার সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় পদার্পন করবো।
১১ই আগষ্ট শুক্রবার। গত শুক্রবার জুম্মার নামায শেষে আমি আমার জান্নাতকে পাই। আজ মাত্র ৬দিনের ব্যবধানে অপ্রত্যাশিতভাবে জান্নাতকে হারাতে বসেছি।  বলির পাঠা হতে চলেছে নিস্পাপ ভালোবাসায় সিক্ত দুটি হৃদয়।
এই ৬টা দিন আমাদের কাছে মনে হয়েছে অনেক অনেক বছর কেটে গেলো দুজন দুজনার অপেক্ষায়। মনে হয়েছে আমরা জনম জনমের সাথী।
আমাদের দুটি হৃদয় দেশের দুই প্রান্তে। আরেক প্রান্তে আমাদের ভাগ্য নির্ধারনের মেলা বসেছে। অবশ্য এটা আদি থেকে চলছে এবং চলবে অনন্তকাল। পৃথিবীতে আমাদের ভাগ্য নির্ধারনের দায়িত্ব একমাত্র তাদের। যারা এখানে বসেছে। নিঃসন্দেহে তারা আমাদের ভালো করার চেষ্টা করেন এবং আজীবন করবেন। দায়িত্ববান মানুষ সব সময় নিজের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকেন।
কিন্তু তারা জানেন না যে, আমরা দুজন শুধু তাদের নয়, নিজেদের অজান্তে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছি। নিজেদের ভাগ্য নিজেরা নির্ধারন করে ফেলেছি।
তাই কোনো এক সম্মানী ব্যাক্তির বড়াপ্পানা কালবৈশাখী রুপে আঘাত হানে আমাদের সুখের স্বর্গে। তিনি কোনো সমাজ মানেন না,  এমনকি মানেন না কোনো যুক্তি। অথচ তার কথাই মানতে বাধ্য আমার জান্নাতের পরিবার। তিনি ভাবছেন আমি নিশ্চই এদের ভালো করছি। তিনি এই ভালোর দোহাই দিয়ে যে,  আমাদের দুটি হৃদয়ের নিস্পাপ ভালোবাসাকে অঝোরে কাদাচ্ছেন তা সত্যিই তিনি জানেন না।  জানলে হয়তো ভূল করেও তারা কোনো যুক্তি তর্কে যেতেন না।
দেনমোহরের দাবীতে তৈরি হলো দুটি গ্রুপ। জান্নাতের বাবা চাচার কথা সাড়ে তিন লক্ষ টাকার নিচে দেনমোহর হবেনা। আমার পরিবারের কথা ছেলের আয় রোজগার ও শরীয়ত মোতাবেক দেনমোহর হোক।
ভালোবাসার একপিঠে চলতে থাকে শরীয়ত মারফতের লড়াই। অন্য পিঠে চোখের জ্বলে ভেসে চলি আমি আর জান্নাত। আরমাত্র দুদিনবাকি। কান্নাজড়িত গলায় জান্নাত ফোন করে আমাকে বলল -"অামি তোমাকে ছাড়া বাচব না। কিছু একটা করো"। জান্নাত ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না, পাগলের মতো কাদছে। আমারও নিজেকে ধরে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। ভালোবাসার মানুষটা অঝোরে কাদছে,  কাদতে কাদতে গলা ভেঙ্গে গেছে। আমি এত দুরে বসে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলামনা। জান্নাতের বাবা জান্নাতের সামনে এলে, মেয়ের কান্না,  মেয়ের মলীন মুখ দেখে নিজেকে সামলাতে পারে না। তাই মেয়ের মতকেই প্রাধান্য দেয়, আবার যখন বাইরে আসে তখন  বড়াপ্পানা পেয়ে বসে, মেয়ের মুখটা ঝাপসা হয়ে যায়। এমতাবস্থায় জান্নাত আমাকে বললো তোমরা আমাকে কাদাচ্ছে। আব্বুর কথা মেনে নিলে কি হবে।  অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম জান্নাতের এমন কথায়।  কিন্তু আমি জানতাম ও কোনো কিছু না বুঝেই বলেছে।
জান্নাতের কষ্টের কথা ভেবে এবং ওর অনুরোধে আর আমার ভালোবাসাকে বাচিয়ে রাখার প্রবল অাগ্রহ নিয়ে আমি জান্নাতের বাবার সাথে কথা বলি। মেনে নেই তার সাড়ে তিন লক্ষ'র দাবী। আমরা ভাবী এই বুঝি সমস্যার অবসান হলো। 
কিন্তু না, ? সমস্যা আরো প্রকট অবস্থা ধারন করলো।  আমাদের জোড়া দেয়ার মধ্যস্থতায় যারা  ছিলো।  তারা পিছু হটতে লাগলো।
জীবন নদীর লাগামহীন তরঙ্গ তছনছ করে দিতে লাগলো সাজানো স্বপ্নের বাগান। ভয়াবহ বজ্রপাতের ও কমতি ছিলো না হৃদয় আকাশে। থরথর করে কাপছিলো বিগত দিনের দাড়িয়ে থাকা শক্ত পা দুটো।
অন্তহীন যন্ত্রনায় পুড়ে ছারখার হতে লাগলো দেহ, মন, প্রান। হৃদয়ের রক্তাশ্রু চোখ দিয়ে ঝরতে লাগলো।  থেমে যেতে লাগলো হৃদয়ের জিহ্বা। 
অবশেষে জান্নাতের বাবাই পুনরায় আমাদের হৃদয় জোড়া দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।  এতে অবশ্য জান্নাতের পরিবারের ছোটবড় সকলের অগ্রনী ভূমিকা ছিলো। পুনরায় অলৌকিক ভাবে জুড়ে গেলো আমাদের দুটি পরিবার। হয়ে গেলো আরো ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর।
ব্যস আর কি, বাগানে ফুটলো নতুন করে ফুলের  কুড়ি, পাখিরদের মিষ্টি গান, কোকিলের কুহুকুহু শব্দে মুখোরিত।
তারিখ যা ছিলো তাই থাকলো। অপেক্ষার মিনিট ঘন্টার চেয়ে বড়। তাই অনেক প্রতীক্ষার পর ১৫ই আগষ্টের সূর্য নতুন সকালের আগমনী বার্তা নিয়ে এলো।
হৃদয়ের মাঝে অফুরন্ত সুখের মাঝে একটা অজানা ভয় খুড়ে খুড়ে খাচ্ছিলো আমাকে। অবশেষে  অপেক্ষার পালা শেষ হলো আর  আমরা হলাম স্বামী স্ত্রী।
কিন্তু এখন আমার একপাশে ভালোবাসার কালো ঘন রোদ্দুর আর একপাশে কষ্টের নীল মেঘ।