রাজস্ব বিক্রয় আইন, ১৭৯৩ সাধারণভাবে ’সূর্যাস্ত আইন’ নামে পরিচিত। এই আইনটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সংক্রান্ত আইনসমষ্টির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৭৯৩ সালের ১৪ নং রেগুলেশনে বিধান করা হয়েছিল যে, রাজস্ব পরিশোধে অক্ষম জমিদারদের জমি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় করে জমিদারদের বকেয়া রাজস্ব আদায় করা হবে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে জমি জমিদারদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।
আরও বিস্তরিত তথ্য পাবেন এখানে
‘সূর্যাস্ত আইন’ বা ‘সান্ধ্য আইন’ - এক নজরে ঝাঁকুনি দেয়ার মতই দুটো শব্দ। হ্যাঁ, প্রথম অনুভূতি সেরকমই ছিল। ইতিহাস বলছে এখন থেকে দুশো বছরেরও আগে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকেরা তৎকালীন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে যে ভূমি ব্যবস্থা চালু করেছিল “সূর্যাস্ত আইন” ছিল তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার ছিল এই আইন। সেই সঙ্গে ইংরেজ প্রভুর শাসন-শোষণ, নিপীড়ণ-নিয়ন্ত্রণেরও খুঁটি বটে।
কিন্তু এতকাল পরে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হলের আবাসিক ছাত্রীদের জন্য এ কোন সূর্যাস্ত আইন চালু হল? এখন না থাকলেও, ঢাক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তো এই “সূর্যাস্ত আইন” প্রচলিত ছিল কয়েক বছর আগেও। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সেই মধ্যযুগীয় নিস্পেষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে। অথচ একই দেশের অন্যতম বড় দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আজও সূর্যাস্ত আইনের নিপীড়নের শিকার (সমকাল, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২, শনিবার, পৃষ্ঠা ২)। ছাত্রী হল কি তবে জেনানা ফাটক ? মেয়েদের জেলখানা ? যেখানে সব ছাত্রীকে ফিরে আসতে হয় সূর্য অস্ত যাওয়ার পরপরই! হাঁস-মুরগী যেমন খোয়াড়ে ঢোকে, সেরকম!!
না, ‘‘সূর্যাস্ত আইন’’ বা ‘‘সান্ধ্য আইন’’ শব্দ দুটো বিশ্ববিদ্যালয় আইনের কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। কর্তৃপক্ষ সেটা স্বীকারও করে না। তবে বলা হয়ে থাকে, এই যে অসংখ্য মেয়ে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে থাকতে আসে তাদের উপযুক্ত নিরাপত্তা বিধানের জন্য এইসব নিয়ম-কানুনের প্রয়োজন আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে যে দায়িত্ব পেয়েছেন সেটা তারা অবশ্যই উপক্ষা করতে পারেন না। অতএব তারা সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেন তাদের দায়িত্ব পালনের। আমাদের আপত্তি সেখানেই। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে আবাসিক ছাত্ররা স্বাধীনভাবে দিনে-রাতে চলাফেরার অধিকার ভোগ করে, ছাত্রীরা কেন সেটা পারবে না? তীব্র বৈষম্যমূলক এসব আইন কেন? মেয়েদের জন্য কেন এই কারাগারের রকমফের ? না-কি ওরা মানুষই না, ভিন্ন প্রজাতির অন্য কিছু !?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে চালু এইসব আইন অবশ্য এখনকার নয়, সেই ১৯২১-২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে প্রণীত হয়েছিল। তারপর গোটা উপমহাদেশে ঘটে গেছে তুলকালাম কত কান্ড; রাষ্ট্র-বিপ্লব থেকে শুরু করে ভাঙা-গড়া-উত্থান-পতন অনেক কিছুই হয়েছে। গড়িয়ে গেছে অনেক পানি পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-কর্ণফুলী দিয়ে। কিন্তু বদলায়নি ছাত্রী হলগুলোর ওইসব আইন। সেসব আইনের বিস্তারিত বর্ণনায় আমরা যাব না। ১৫ সেপ্টেম্বর সমকালে-র প্রতিবেদনের মাধ্যমে সচেতন পাঠকমাত্রেরই তা জানার কথা। এবং এই প্রেক্ষাপটে স্বীকার করতেই হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটিকে কোনমতেই ছোট করে দেখতে পারেন না। পারে না, পারছে না ছাত্রীরাও। প্রশ্নটির সঙ্গে আমাদের গোটা সমাজে মেয়েদের অবস্থান, তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। হলে যারা থাকতে আসে তাদের অভিভাবকদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে নিজেদের একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসাবে ধরে নিয়েই নিজের নিজের মেয়েদের হলে থাকতে পাঠান। এই মেয়েদের একটা ন্যূনতম নিরাপত্তা ও সম্মানজনক বসবাসের নিশ্চয়তা তারা আশা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। কারণ তারা জানেন এবং মানেন এদেশের পথঘাট এখনও মেয়েদের জন্য নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। অধ:পতিত এই বিকৃত-বিকলাঙ্গ-ভাঙাচোরা সমাজের সর্বত্র অবাধে বিচরণ করে মানুষরুপী দুর্বত্তরা, ইতরগুলো। নিজেদের মেয়ে-বোনের জন্য দুশ্চিন্তা এবং তাদের নিরাপত্তার চিন্তা তাদেরকে উদ্বিগ্ন করে রাখবে এটা খুবই স্বাভাবিক। মেয়েরা বড় হয়েছে, যথেষ্ট দায়িত্বজ্ঞান জন্মেছে তাদের, তারা ভোট দিতে পারে, অনার্স-মাস্টার্স পড়ছে; তারপরও অভিভাবকেরা তো দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারেন না। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অমন নির্বিবাদে চালু রাখতে পারেন গত শতাব্দীর বিশের দশকে প্রণীত আইন, যা কি-না প্রতি পদে পদেই ব্যঙ্গ করে চলছে আমাদের এই “আধুনিক” সমাজ ও তার নারীমুক্তি, নারী অধিকার ও নারী স্বাধীনতার বুলিকে ।
হ্যাঁ, বুলিই বটে। নইলে এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসেও কেন এইসব উজ্জ্বল আলোকিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েদের প্রতি সন্ধ্যায় মুখোমুখি হতে হয় “সূর্যাস্ত আইন”-র ? তার কারণটাও তো অজানা নয়। ওই যে হল গেটের তালা কিংবা কঠোর দ্বাররক্ষী, এরা তো সমাজবিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার নয়। প্রতীক তারা গোটা সমাজব্যবস্থার। যার অধীনে মেয়েরা প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে - আজও, এই “আধুনিক” বাংলাদেশেও। হলের ভেতরে যে ফ্যাশনদুরস্ত বসবাসের ব্যবস্থা আছে তা বৃহত্তর সমাজের নারী নিগ্রহের মারাত্নক চিত্রটাকে কি ঢেকে রাখতে পারে? না, ছাত্রীহলগুলো কোন বিছিন্ন ব্যাপার নয়। বিচ্ছিন্ন নয় রাজশাহী কিংবা চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও বৃহত্তর সমাজ থেকে। ছাত্রীহলে প্রচলিত যে বিধি-ব্যবস্থা নিয়ম-কানুন, তা গড়ে উঠেছে এই নষ্ট সামাজের চাওয়া-পাওয়ার উপর ভিত্তি করেই। গোটা সমাজ যেখানে মেয়েদের সম্মান দিতে পারে না, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেখানে আলাদাভাবে কতটুকু পারেন বা পারবেন এগিয়ে যেতে? সমাজে যেখানে সামন্তবাদী ভূত-প্রেতের অপ্রতিহত অন্ধকারের রাজত্ব এখনও দোর্দন্ড প্রতাপে বিদ্যমান সেখানে ছাত্রীহলে ওইসব অমানবিক আইন এখনও চালু থাকবে তাতে কি খুব অবাক হওয়ার কিছু আছে?
ইংরেজ প্রণীত “সূর্যাস্ত আইন” ছিল পুরোপুরী সামন্তবাদী প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত। আপাতদৃষ্টিপে প্রেক্ষিত ভিন্ন বলে মনে হলেও আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু “সূর্যাস্ত আইন” প্রকৃতিতে ও মেজাজে কি আসলেও অতটা আলাদা ? না, আমরা তা মনে করি না। পুরুষশাসিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজকোঠামোতে নারীর অধস্তনতা ও অধিকারহীনতার বিষয়টিও আসলে আগাগোড়াই সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা থেকে উদ্ভূত। সেই সামন্তবাদী ব্যবস্থায় জমি যেমন ব্যক্তিপুরুষের মালিকানাধীন, মেয়েরাও তেমনি। জমির মত সে-ও পুরুষের সম্পত্তি বৈকি। আমাদের গ্রামে-গঞ্জে এখনও “জমি ও জরু” বলে একটি কথার চল আছে। “জরু” মানে স্ত্রী, ব্যাপকঅর্থে নারী। সেইজন্যই দেখা যায় মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করার কলা-কৌশল কল-কব্জাগুলো তাই সৃষ্টি হয়েছে সামন্তবাদী উপাদান-উপকরণ দিয়ে। যুগবিশেষে এখানে-সেখানে কিছু হের-ফের হলেও, সমাজের বহিরঙ্গে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া বা প্রলেপ লাগলেও আমরা প্রকৃত অর্থে সামন্তবাদী প্রভাবমুক্ত আধুনিক সমাজ এখনও গড়ে তুলতে পারিনি।
অতএব বিদ্যমান সমাজ-ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা মেয়েরা “সূর্যাস্ত আইন”-র শিকার হবেই। ছাত্রীহল থেকে এইসব আইন উঠে গেলেও বাইরের বৃহত্তর সমাজে কোটি কোটি সাধারণ মেয়েরা নিয়ন্ত্রিত ও নিগৃহীত হতেই থাকবে। আইনের বদল আমরা অবশ্যই চাই। কিন্তু এইসব অমানবিক আইন গড়ে উঠে যে সমাজের প্রয়োজনে সেই সমাজকেও না বদলালে আইনের প্রয়োগ সীমিত থেকে যেতে বাধ্য। অতএব শুধু হলের “সূর্যাস্ত আইন” নয়, আঘাত করতে হবে আসলে গোটা সমাজকাঠামোকেই। ভাঙতে হবে শুধু হলগেটের তালা নয়, বিদ্যমান সমাজ নামক বৃহৎ কারাগারটিকেও বিনাশ করা চাই। এ সমাজ পদে পদে বেড়ী পরায় মেয়েদের হাতে-পায়ে-দেহে-মনে-চেতনায়। তাই বদলাতে হবে সেই বিধিব্যবস্থার কাঠামোটিকে। নারী-পুরুষ সাম্যতার আগে তা নিশ্চিত হবে না। সমাজ ও তার মানসিকতা পরিবর্তনের সেই কাজটি অনেক বেশি জরুরী, সে সংগ্রাম অনেক বেশি কঠিন। কিন্তু এছাড়া অন্য কোন পথও তো নেই, নেই