অভিজ্ঞতা থেকে বলছি
বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারী , চাকুরীর আশায় প্রথম রাজধানীর বুকে চড়ে বসা। এর আগে বহুবার ঢাকায় এসেছি কিন্তু চাকুরী করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এই প্রথম। ঢাকায় আসার তেমন কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। তবুও জীবনের তাগিদে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে ঢাকার বুকে গজিয়া ওঠা। তীব্র যানযট আর মানুষের উপচে পড়া ভীড় বরাবর আমার অপছন্দর তালিকায় । কিছু করার নেই জীবন কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় এটা বলার সাধ্য কোন মানুষের নাই। মানুষের ভাগ্য মানুষকে নিয়ন্ত্রন করে। তাই খুলনায় আমার ভাগ্য প্রসন্ন হলো না। ভাগ্য ও রিজিকের সন্ধানে হাতরে বেড়াতে লাগলাম ঘুটঘুটে অন্ধকারে ।একবিন্দু আলোর আশায় স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।
ইন্টারভিউ আর সিভি জমাদানের মধ্যে দিয়ে সময়ের সাথে সাথে ব্যয় হতে থাকে জমানো অর্থ। কংক্রিটের এই নির্মম শহরে আমার আশ্রয় হলো , আমার ছোটবেলার বন্ধু শাহিনের কাছে। ফেব্রয়ারির ১৫ তারিখে আমার হাতে ধরা দিল সেই কাংখিত হরিনটি। যার শিং নাই, লোম নাই, একেবারে বাচ্চা। কিছু কথা না বললেই নয়, তাই এবার আসি সেই না বলা কথায়।
শিং নাই , লোম নাই , বাচ্চা বলার কারন হলো। চাকরি ঠিকই পেলাম কিন্তু অনেক না পাওয়া বহাল থেকে গেলো। মাসে বেতন মাত্র ৮০০০ টাকা। সারাদিন গাধার খাটুনি মাস শেষে ৮০০০ টাকা। রোদ বৃষ্টি এবং রাস্তার ধোয়াটে ধুলাগুলো নিত্য সঙ্গি। আরো আছে কিছু অপ্রত্যশিত বঞ্চনা ও গঞ্জনা। যা প্রকাশযোগ্য নয়। সামনের দিনগুলো হয়তো ভালো কাটবে এমন ছোট ছোট অধরা স্বপ্ন নিয়ে ভালোই কাটছিল দিন।
এপ্রিলের কোন একদিন শাহিন বলল, দোস্ত আমার ফ্যামিলি নিয়ে আসবো, তোমার যে অন্য ব্যবস্থা করতে হয়। ঠিকই তো আমার জন্য কি শাহিন তার পরিবার বাদ দিয়ে দেবে। বরং পরিবার থেকে দুরে থেকে সে তার পরিবারের প্রতি হক আদায় করছে না। শাহিনের ১বছরের ছেলে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শাহিন আমাকে একমাস সময় দিলো বাসা খুজে নেবার জন্যে। সত্যি বলতে গেলে এমন বন্ধু সবার ভগ্যে জোটে না। আমি অনেক সহযোগীতা পেয়েছে শাহিনের কাছ থেকে , যা আমার কোনো আপনজনও করেনি।
দু-চারদিনের খোজাখুজির পর উত্তরায় একটি মেসে জায়গা পেলাম। উত্তরায় অফিস হবার সুবাদে উত্তরাতেই মেস নিতে হলো। কারেন্টবিল বাদে ৩০০০ টাকা সিট ভাড়া। সিট বলতে একরুমে চারজন করে থাকে। তাদের সাথে বিনা ভাড়ায় থাকে অসংখ্য ছারপোকা। একজনের শার্ট পরে আরেকজন চলে যায়। একজনের পানি খারার আরেক জন খেয়ে ফেলে এমন আচরন নিত্যনৈমিত্তিক। অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্নতার কথা না হয় নাই বললাম। অামি আর নিতে পারছি না, ধৈয্য হারিয়েছি অনেক আগে , তাই আত্মসম্মানটুকু বাচিয়ে নেবার প্রবল ইচ্ছা।
একই মেসে সিঙ্গেল রুম নিলাম। ভাড়া ৪০০০ টাকা কারেন্ট বিল বাদে। দেখালো এক মাসের প্রথম দিলো আরেক। রুম নয় পতিত কিচেনঘর। কি আর করার ভাগ্য যখন এখানে নিয়ে এলো । ঢাকার শহরে মানুষের মনুষত্ব কোথায় আছে খুজে পাওয়া যাবে না। বিবেকটাও তারা বিসর্জন দিয়েছে বাচার তাগিদে।
মেসে মাসশেষে খাবারের বিল তুলনামুলক বেশি আসতে লাগলো। বুঝতে পারলাম ওরা ইচ্ছা করেই এমটা করে। আমার একার নয় সবার বেলায় এমন। বিবেক বিসর্জন দিয়ে ওরা ব্যবসায় নেমেছে। রাতে খেতে যেতে দেরি হলে , কখনো ভাত পাওয়া যেত না। আবার মাঝে মাঝে ভাত আছে তরকারি নাই। তাতে কারো কোন যায় এসে না, মাস গেলে টাকা গুনতে হবে। এটা এক প্রকার নির্যাতন। মুখবুজে সব সহ্য করে থাকলাম শুধু টাকার জন্যে। এখানে মানুষের বিবেক মনুষত্ববোধ, আত্মসম্মান আছে বলে মনে হয় না। এখানে ভদ্রলোকগুলো কষ্ট করে আর চিটার বাটপার ফয়দা লুটে।
শুধু খাওয়া আর বাসা ভাড়া দিলে চলবে।নিত্যদিন আারো অনেক খরচ আছে। তাই খাবার খরচ কমানোর জন্য রাতে অর্ধেক ভাত খেতাম আর অর্ধেক পানি দিয়ে রেখে দিতাম। সকালে লবন দিয়ে চটকে দিব্যি গলদকরন করে রেরিয়ে পড়তাম অফিসের উদ্দেশ্যে। উপায় নাই একদিক বাচালে আরেক দিকে মারবে। মশার উৎপাত এতো বেশি যে একদিনে একটি মশার কয়েল লাগে। গরমের কথা নাই বলি। বেতন পেযে ভাবতাম এবার একটা ফ্যান কিনতে হবে। কিন্তু যাবতীয় খরচ মিটিয়ে হাতপাখা ও জুটতো না। তাই বই বা মোটা কাগজের বাতাস নিয়ে শীতল হবার বৃথা চেষ্টা করতাম। কথায় আছে বিপদ কখনো একা আসেনা। সে তার দলবল নিয়েই আসে। ।আজো মনে পড়ে সেই রাতের কথা। অসহ্য গরমের মাঝেও ঠান্ডায় আমার দাতে দাত লেগে যাবার উপক্রম। তখন ফ্লোরিং করে ঘুমাতাম। সারাদিন শরীরটা তেমন ভালো কাটেনি । কাজে ফাকি দিয়ে অফিস টাইম শেষ হবার ঘন্টা খানেক আগেই বাসায় ফিরে এসেছি। রাতের আধারের সাথে সাথে শরীরটাও ঝিমিয়ে আসতে লাগলো। রাত যখন সাড়ে এগারোটা তখন সারা শরীরে কাপুনি দিয়ে জ্বর। কাথা বা কম্বল কোনো কিছুই নাই শুধু বিছানার সিঙ্গের তোশক আর চাদর। তিন-চারটা শার্ট গায়ে ঢুকালাম তবু শীত মানছে না । দাতে দাত বাড়ি খাচ্ছে। কি আর করার তোশকের সাথে নিজেকে মুড়ে ফেললাম। এতো অসুস্থতার মাঝেও মাথায় একটা টেনশন খুব কাজ করে কাল অফিসে যেতে পারবো কি না।